রাজু আহমেদ: প্রকাশিত, ১১ মার্চ ২০২৫
ঢাকার মিরপুর ১২-এর অভিজাত একটি মদের বারে যেন হঠাৎ করেই নেমে এসেছে নিস্তব্ধতা। যেখানে প্রতিদিন সন্ধ্যার পর উচ্চস্বরে বাজতো গান, চলত পানাসক্তদের উন্মাদনা, সেখানে এখন কেবল ফাঁকা চেয়ার আর ধুলো জমতে থাকা টেবিলগুলো সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক সময়ের কোলাহলের।
মদের বারে ভিতরে সুনসান বাইরে চাকচিক্য লাইটিং সাজ ভিডিও;
রমজান মাসের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে এই পরিবর্তন আরও স্পষ্ট হয়েছে। নিয়মিত আসা অনেকেই এখন এড়িয়ে যাচ্ছেন এই স্থান। কেউ ধর্মীয় পবিত্রতার খাতিরে, কেউবা নিরাপত্তার শঙ্কায়। যে জায়গাটিতে রাতভর মাতাল হয়ে চলত উন্মত্ত নাচ-গান, তা এখন যেন এক ভৌতিক পরিবেশের প্রতিচ্ছবি।
রাজনীতি, ক্ষমতা আর ব্যবসার যোগসূত্র
এই মদের বারটির অবস্থান মিরপুরের বহুল আলোচিত মোল্লা পরিবারের মালিকানাধীন এক অভিজাত মার্কেটে। পরিবারটি রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায়, তাদের সম্পদের ওপর খুব বেশি কেউ হাত দিতে সাহস পায় না। জানা গেছে, মার্কেটটির কিছু অংশ সরকারি জমির ওপর গড়ে উঠেছে, এবং ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে বহুতল ভবনের পিলার পর্যন্ত সরকারি জায়গায় বসানো হয়েছে। স্থানীয়রা মনে করেন, এই পিলারগুলো সরানো হলে পুরো মার্কেটই ভেঙে পড়তে পারে।
মোল্লা পরিবারের অধিকাংশ সদস্যই বর্তমানে পলাতক থাকলেও, তাদের ব্যবসা ঠিকই সচল রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগের ছত্রচ্ছায়ায় বেড়ে ওঠা এই পরিবারটির সম্পদ এখন দেখভাল করছে কিছু নামধারী বিএনপি নেতা। ৫ আগস্টের পর যখন দেশের বিভিন্ন জায়গায় ক্ষমতাসীনদের সম্পত্তির ওপর হামলা হয়, তখনও এই পরিবারের ব্যবসায় কোনো আঘাত আসেনি। বরং ক্ষমতার মিশেলে দুই দলই এখানে স্বার্থ রক্ষা করছে, ফলে নিরাপত্তা বজায় রাখতে সার্বক্ষণিক পাহারায় থাকছে কিছু গোপন প্রহরী।
রমজানে কেন কমেছে ভিড়?
প্রায় ১২ হাজার স্কয়ার ফিটের এই মদের বারে প্রবেশের জন্য রয়েছে বিশেষ লিফট। নির্দিষ্ট বাটন চাপলেই পৌঁছে যাওয়া যায় নিচতলা থেকে ভেতরের বিলাসবহুল পরিবেশে। প্রতিদিন বিকেল থেকে গভিররাত পর্যন্ত চলত আড্ডা, মদ্যপান, আর উদ্দাম নৃত্য। তবে রমজান শুরু হওয়ার পর থেকেই সেখানে ভিড় কমে গেছে।
এর পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে:
ধর্মীয় সংযম: অনেক নিয়মিত অতিথিই পবিত্র রমজান মাসে মদের বারমুখী হওয়া থেকে বিরত রয়েছেন।
নিরাপত্তার শঙ্কা: সাম্প্রতিক সময়ে মোবাইল চুরি, ছিনতাই এবং ব্ল্যাকমেইলের ঘটনা বাড়তে থাকায় অনেকেই এখন আর আগের মতো নির্ভয়ে এখানে আসতে চান না।
সময়ের পরিবর্তন: রাতের গভীরে সড়কে যেখানে নারী-পুরুষ একসঙ্গে মাতাল হয়ে তুমুল ঝগড়া-মারামারি করত, সেখানেও এখন নীরবতা নেমে এসেছে।
অন্ধকার জগতের লুকোচুরি
মিরপুর ১২-এর এই মদের বার বন্ধ থাকলেও, শেওড়াপাড়া উত্তরা বনানী গুলশানের কিছু বারে এখনও গভীর রাত পর্যন্ত চলছে পার্সেল বিক্রির নামে গোপন মদের বেচাকেনা। রাজধানীর বেশ কিছু বারে ভাড়ায় আসা নারীরা মদ্যপদের মনোরঞ্জন করে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। আবার অনেক তরুণ-তরুণী বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার ছলে ব্ল্যাকমেইলের শিকার হচ্ছে, হারাচ্ছে অর্থসম্পদ। লোকলজ্জার ভয়ে কেউ থানা-পুলিশ পর্যন্ত যেতে পারে না, শুধু গুমরে গুমরে কাঁদে—‘কেন গিয়েছিলাম মাত্র কয়েক ঘণ্টার আনন্দের জন্য?’
রমজানের পর কি আবার ফিরবে আগের দৃশ্য?
এটাই এখন বড় প্রশ্ন। রমজানের পর কি আবারও এই বিতর্কিত মদের বারে ভিড় জমতে শুরু করবে? নাকি সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এখানকার উন্মত্ত রাতগুলো চিরতরে হারিয়ে যাবে?
সময়ই দেবে তার উত্তর। তবে আপাতত মিরপুর ১২-এর মদের বারটি পড়ে রয়েছে একাকী, অতীতের স্মৃতি নিয়ে, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা নিয়ে।