মুদি দোকানদার থেকে ওভারসীজ এর মালিক বনে যাওয়া মধ্যপ্রাচ্যে মানবপাচারকারী চক্রের অন্যতম হোতা টুটুল ও সহযোগী তৈয়বসহ ০৮ জনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব-৪।
বাংলাদেশ একাত্তর.কম/ নিউজ ডেস্ক:
সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকজন নারী ভিকটিমের অবিভাবক মধ্যপ্রাচ্যে মানবপাচার সংক্রান্ত অভিযোগ র্যাব-৪ এ জানায়। ফলশ্রুতিতে র্যাব ছায়া তদন্ত শুরু করে ও গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। এরই ধারাবাহিকতায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অদ্য ১৩ অক্টোবর ২০২১ ইং তারিখ দুপুর ১২টার দিকে র্যাব-৪ এর একটি আভিযানিক দল বাড্ডা থানাধীন লিংক রোডস্থ টুটুল ওভারসীজ, লিমন ওভারসীজ ও লয়াল ওভারসীজে অভিযান চালিয়ে ৪ জন ভিকটিম (২ জন পুরুষ এবং ২ জন নারী), ১০ টি পাসপোর্ট, ৭ টি ফাইল, ৪ টি সীল, ১৭ টি মোবাইল, ৫ টি রেজিষ্টার, মোবাইল সীম ৩ টি, ৪ টি ব্যাংকের চেক বহি, ২ টি কম্পিউটার, ৩ টি লিফলেট এবং নগদ ১০,০৭০/-টাকাসহ মানব পাচারকারী চক্রের অন্যতম হোতা টুটুল ও সহযোগী তৈয়বসহ নিম্মক্ত ৮ জন’কে গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতারকৃতরা হলো-১। মোঃ সাইফুল ইসলাম @ টুটুল (৩৮), জেলা-মেহেরপুর, ২। মোঃ তৈয়ব আলী (৪৫), জেলা- রংপুর, ৩। শাহ্ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন লিমন (৩৮), জেলা- গোপালগঞ্জ, ৪। মোঃ মারুফ হাসান (৩৭), জেলা- পটুৃয়াখালী,
৫। মোঃ জাহাঙ্গীর আলম (৩৮), জেলা- মেহেরপুর ৬। মোঃ লালটু ইসলাম (২৮), জেলা- মেহেরপুর, ৭। মোঃ আলামিন হোসাইন (৩০), জেলা- শরয়িতপুর, ৮। মোঃ আব্দল্লাহ আল মামুন (৫৪), জেলা- কুষ্টিয়া।
প্রতারক টুটুল ও তৈয়বের উত্থানঃ গোপন অনুসন্ধানে দেখা যায় এইচএসসি পাশ টুটুল মেহেরপুরের গাংনী থানাধীন কামন্দী গ্রামে মুদি দোকানদার হিসেবে কাজ করতো। মাঝে মাঝে ঢাকায় আসত। অতি অল্পসময়ে অধিক টাকার মালিক হওয়ার লোভে ধীরে ধীরে মানবপাচারকারী কোন চক্রের সাথে জড়িয়ে পড়ে এবং চক্রের দালাল হিসেবে বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশে লোক পাঠানোর কাজ করতে থাকে। পরবর্তীতে নিজেই রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় প্রতারণামূলকভাবে “টুটুল ওভারসীজ, লিমন ওভারসীজ ও লয়াল ওভারসীজ” নামে ৩ টি ওভারসীজ এজেন্সির অফিস খুলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বেকার ও শিক্ষিত বহু নারী ও পুরুষকে বিদেশে পাঠানোর কথা বলে তাদের নিকট থেকে লাখ লাখ টাকা প্রতারণামূলকভাবে গ্রহণ করে।
আরো জানা গেছে টুটুলের এই প্রতারণার কাজে অন্যতম দালাল বা সহযোগী আবু তৈয়ব। সে কোনো পড়াশুনা জানেনা। চায়ের দোকানদারী করতো। টুটুলের প্ররোচনায় মানব পাচারকারী চক্রের সাথে জড়িয়ে পড়ে এবং বহু লোককে প্রতারণামূলক ভাবে বিদেশে প্রেরণ এবং দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকুরী দেয়ার নামে প্রতারণামূলক ভাবে টাকা পয়সা গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে। তৈয়ব নিজেকে দেশের একটি সনামধন্য এয়ারলাইন্সের ম্যানেজার হিসেবে পরিচয় দিয়ে দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনে চাকুরী এবং দেশের নামী-দামী মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে চাকুরী দেওয়ার নাম করে বিপুল পরিমান অর্থ আত্মসাৎ করেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কয়েকজন ভিকটিমকে চাকরি প্রদানের ভূয়া নিয়োগপত্র ও দিয়েছে।
এছাড়াও গ্রেফতারকৃত মানবপাচার চক্রের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে শাহ্ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন লিমন (৩৮) ও মোঃ মারুফ হাসান (৩৭) বেতনভুক্ত কর্মচারী। মোঃ জাহাঙ্গীর আলম (৩৮), মোঃ লালটু ইসলাম (২৮), মোঃ আলামিন হোসাইন (৩০), মোঃ আব্দল্লাহ আল মামুন (৫৪) এরা মাঠ পর্যায়ে টার্গেট সংগ্রহ, প্রার্থীর পাসপোর্টের ব্যবস্থা, কথিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, টাকা সংগ্রহ, প্রাথমিক মেডিকেল সম্পূর্ণ করাসহ অন্যান্য কাজে সহয়তা করত।
১। বিদেশে পাচারের উদ্দেশ্যে প্রতারনার কৌশলঃ প্রতারক টুটুল ও তৈয়বের নির্দেশে এই চক্রের অন্যান্য সদস্যরা টার্গেট সংগ্রহের কাজে নিম্মক্ত কৌশল অবলম্বন করতঃ
২। টার্গেট সংগ্রহঃ এই পাচারকারী চক্রের কিছু সদস্য দেশের বেকার ও অস্বচ্ছল যুবক-যুবতীদের সৌদি আরব, জর্ডান ও লেবাননসহ বিভিন্ন দেশের বাসাবাড়ীতে লোভনীয় বেতনে কাজ দেওয়ার নাম করে রাজি করিয়ে ঢাকায় নিয়ে এই চক্রের মূলহোতা টুটুল ও তৈয়বের কাছে নিয়ে আসে।
৩। টাকা সংগ্রহঃ টুটুল ও তৈয়ব তাদের অফিসে সংগ্রহীত ভিকটিমদের বিদেশে বাসাবাড়ীতে কাজের নামে পাঠানোর উদ্দেশ্যে ভ‚য়া মানি রিসিপ্ট প্রদান করে ভিকটিম প্রতি ২-৫ লক্ষ টাকা করে নিত।
৪। প্রশিক্ষণ প্রদানঃ প্রতারণার উদ্দেশ্যে এই পাচারকারী চক্রের কয়েকজন সদস্য নিজেদেরকে উচ্চশিক্ষিত বলে পরিচয় দিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত ভিকটিমদের’কে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের বাসাবাড়িতে কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে ভিকটিমদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা আদায় করতো।
৫। পাসপোর্টসহ অন্যান্য কাগজপত্র সংগ্রহঃ এই পাচারকারী চক্রের কয়েকজন সদস্য অফিস স্টাফ হিসেবে পরিচয় দিয়ে ভিকটিমকে বিদেশে পাঠানোর জন্য পাসপোর্ট করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ভিকটিমদের কাছ থেকে সংগ্রহ করতো। এতে করে ভিকটিমদের মনে আর কোন সন্দেহ থাকত না। এই চক্রের কিছু সদস্য পাসপোর্ট অফিসের দালালদের সাথে সখ্যতা গড়ে ভিকটিমদের পাসপোর্ট তৈরি করে দিত।
৬। মেডিকেল সম্পূর্ন করাঃ এই পাচারকারী চক্রের মূলহোতা টুটুল ও তৈয়বের নির্দেশে ভিকটিমদের বিদেশে যাওয়ার জন্য লোক দেখানো মেডিকেল সম্পূর্ন করা হতো।
৭। বিক্রির উদ্দেশ্যে বিদেশে পাচারঃ সকল প্রক্রিয়া সম্পর্ন করে কয়েকজনকে বিদেশে পাঠিয়ে বাসাবাড়ীতে কাজের কথা বলে বিশেষকরে নারী ভিকটিমদের’কে বাসাবাড়ীতে বিক্রি এবং পুরুষ ভিকটিমদের’কে অমানবিক কাজে নিয়োজিত করার উদ্দেশ্যে সৌদি আরবের জেদ্দা ও রিয়াদ, জর্ডান ও লেবাননে টাকার বিনিময়ে বিক্রি করতো। উল্লেখ্য যে বিদেশে পাচারকৃত ভিকটিমরা বিদেশে গিয়ে পরিবারের সাথে আর কোন যোগাযোগ করতে পারত না। যাদেরকে বিদেশে পাঠাতে পারত না তারা টাকা ফেরতের আশায় অফিসে যোগাযোগ করলে তাদেরকে বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের টাকা না দিয়ে আত্মসাৎ করে আসছিল।
৮। চাকুরী প্রদানের উদ্দেশ্যে প্রতারণাঃ এই চক্রের অন্যতম মূলহোতা গ্রেফতারকৃত তৈয়ব নিজেকে একটি সনামধন্য এয়ারলাইন্সের ম্যানেজার হিসেবে পরিচয় দিত। এই চক্রের কিছু সদস্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চল হতে শিক্ষিত বেকার তরূণ-তরূণীদের উচ্চ বেতনে লোভনীয় চাকুরীর কথা বলে সংগ্রহ করে তৈয়বের অফিসে নিয়ে আসতো। প্রতারক তৈয়ব উক্ত ভিকটিমদের দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনে চাকুরী সহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠানে ভ‚য়া চাকুরীর যোগদাপত্র প্রদান করে বিপুল পরিমান অর্থ আত্মসাৎ করে আসছিল।
৯। অভিযোগকারী ব্যক্তির বক্তব্যঃ
১০। র্যাব-৪ এর কাছে জনৈক মোঃ আশরাফুল ইসলাম, জেলা-গাইবান্ধা অভিযোগ করেন তার ভাতিজি আসমা বেগম (পিতা-মৃত ফরিদ মিয়া) তৈয়ব ও টুটুলের মাধ্যমে প্রতারণার শিকার হয়ে গত ০৯ জুন ২০২১ জর্ডান যায়। তাকে বাসাবাড়িতে কাজের কথা বলে পাঠানো হলেও সে পাচার হয়েছে বলে তারা আশঙ্কা করেন। যাওয়ার প্রায় ০১ সপ্তাহ যোগাযোগ থাকলেও এখন আসমার কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছেনা। এরকম বেশ কয়েকজন নারী ও পুরুষকে প্রতারণামূলকভাবে সৌদআরবে পাঠিয়ে বিক্রি করেছেন মর্মে তিনি জানতে পারেন বলে র্যাব-৪ এর কাছে অভিযোগ করেন।
১১। ভিকটিম মোছাঃ মোরশেদা বেগম (৩৪), মোছাঃ হামিদা আক্তার (৩২), মোরশেদা বিবি (৩২) এবং মালেকা বেগম (৫১) একই উপায়ে তৈয়বের কাছে বিদেশে যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট সহ অন্যান্য কাগজপত্র জমা দেয়। এর মধ্যে মোরশেদা বেগম (৩৪) ও হামিদা আক্তার (৩২) দুইজনকে অভিযানকালে উক্ত কথিত টুটুল এর অফিস থেকে উদ্ধার করা হয়। এবং মোরশেদা বিবি ও মালেকা বেগম প্রতারনার শিকার হয়ে দুই বছরের অধিক সময় তৈয়ব ও টুটুলের নিকট ঘোরাফিরা করছেন। তারা র্যাব-৪ এর নিকট প্রতারণার ও পাচার সংকান্তে তথ্য প্রদান করেন। এ সংক্রান্তে আরও ২০/২৫ জনের অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে। ভিকটিমদের কাছ থেকে প্রতারণামূলকভাবে ১ লক্ষ থেকে ৩ লক্ষ কোন কোন ক্ষেত্রে ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত অর্থ আত্মসাৎ এর অভিযোগ রয়েছে।
১২। মূল অভিযোগ সমূহঃ
উক্ত প্রতিষ্ঠানের সকল কার্যক্রম অবৈধ ও প্রতারণামূলক।
টুটুল ওভারসীজ, লিমন ওভারসীজ, ও লয়াল ওভারসীজ নামক উক্ত প্রতিষ্ঠানের মন্ত্রনালয় কর্তৃক অনুমোদিত নয়।
প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট কোন অফিসিয়াল সাইনবোর্ড নেই।
কোম্পানী কর্তৃক সরকারী কোন ভ্যাট/ট্যাক্স প্রদান করা হয় না। ১৩। গ্রেফতারকৃত আসামীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।