বাংলাদেশ একাত্তর.কম/ সুমন হোসেনঃ
বছর দু’য়েক আগে বিহারী ক্যাম্পে জায়গা ভাড়া নিয়ে ১০ টি বেনারসির কারখানা চালু করেন বেনারসি পল্লীর বাসিন্দা শাকিল খান। ব্যবসায় মন্দা থাকায় বছর না যেতেই ৭ টি কারখানা বন্ধ হয় যায়। এরপর করোনায় টানা ৫ মাস কারখানা বন্ধ ছিলো। ভাড়া জমেছে অনেক। উপায়ান্তুর না দেখে ২ টি কারখানা ছেড়ে দেন। অন্যটি চালু থাকলেও ৩ মাসের ভাড়া বকেয়া। কাজ নেই, অর্ডার নেই এরপর হয়তো এটিও বন্ধ হয়ে যাবে। গত কয়দিন মিরপুর বেনারসিপল্লী ঘুরে ঠিক এ রকম চিত্রই দেখা গেছে।
তাঁতীরা অন্য পেশায় যুক্ত হয়েছেন। হয়তো সংখ্যায় লাখ ছাড়িয়ে যাবে। এখনো যে তাঁত রয়েছে এর মধ্যে ৫ ভাগ সচল রয়েছে। তাও বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। করোনায় মার্চ মাস থেকে ব্যবসা নেই। অনেকে লোকসান দিয়ে কারখানা টিকিয়ে রেখেছেন। হয়তো পরিস্থিতির উন্নতি হবে এ আশায়। আর তা না হলে সবই গুঁড়েবালি। মিরপুরের বেনারসি শাড়ি বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারত ও পাকিস্তানের নারীদের অন্যতম পছন্দের পোশাাক। নানা উৎসব ও পার্বনে পোশাক হিসেবে শাড়ি আজও বাঙ্গালি নারীর পছন্দের শীর্ষে। আর সেটি যদি হয় ঢাকার মিরপুরের বেনারসি শাড়ি তাহলে তো সোনায় সোহাগা। জনশ্রুতি রয়েছে ২০০২ সালে বলিউডে নির্মিত সঞ্জয়লীলা বানসালির দেবদাস সিনেমার জন্য মিরপুরের ২ টি বেনারসি শাড়ি নেওয়া হয়েছিল। অবশ্য এখন আর সেই জৌলুস নেই মিরপুরের বেনারসি পল্লীতে। নিজেদের অবহেলায় সব হারিয়ে যেতে বসেছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পূর্ণ এ শিল্পের সূর্য আজ অস্তমিত! ধ্বংস প্রায় বেনারসি তাঁত শিল্প। সংশ্লিষ্টদের দাবি এখনই কার্যক্রর পদক্ষেপ না নিলে খুব শীঘ্রই ইতিহাসের পাতায় নাম লেখাবে এ শিল্প।
মিরপুর বেনারসি পল্লীর ব্যবসায়ী ও তাঁতীরা জানান, ভারতীয় বেনারসি শাড়ির প্রভাবে বাংলাদেশের তৈরি বেনারসি শাড়ি অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। বেশ কয়েক বছর ভারতের মিলে (পাওয়ার লুম মেশিন) উৎপাদিত কমদামি বেনারসি শাড়ির কারনে হোঁচট খেতে শুরু করে দেশীয় এ শিল্প।ভারতের বিভিন্ন মিলে তৈরি হওয়া বেনারশি শাড়ি দামে কম ও সাশ্রয়ী। মেশিনে তৈরি বিধায় দেখতে নিখুঁত ও রং চকচকে। তাই হাতে তৈরি শাড়ী থেকে সরে গিয়ে ক্রেতারা ঝুঁকছে ভারতীয় শাড়ির দিকে। অবশ্য মানের দিক থেকে ভারতীয় বেনারসি শাড়ি এ দেশের বেনারসির অনেক পিছনে। অথচ নিজেদের অবহেলায় ইতিমধ্যে ৯০ ভাগ তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে। মিরপুর ১০ নম্বর বেনারসি পল্লীর তাঁতি সম্প্রদায়ের বাসিন্দা মান্না বেনারসি শাড়ির বর্তমান অবস্থা নিয়ে বলেন, কম দামি ও নিম্মমানের ভারতীয় বেনারসি শাড়ির প্রভাবে আমাদের দেশের ঐতিহ্যবাহী বেনারসি শাড়ি আজ হারিয়ে যাচ্ছে। অবস্থা এতই বেগতিক যে এক থেকে দুই বছরের মধ্যে তাঁত কিংবা তাঁতী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে। তিনি বলেন, আজ থেকে ১০ বছর আগে যেখানে ২০-২২ হাজার তাঁতী এ কাজে জড়িত ছিল আজ তা শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। বর্তমানে বড় জোর ৪০০- ৫০০ জন তাঁতী এ পেশায় যুক্ত রয়েছেন। তিনি বলেন, শোরুম মালিকরা কমদামি ভারতীয় বেনারসি শাড়ি এনে এ শিল্পের বেহাল অবস্থা করেছেন। তারা যদি ভারতীয় শাড়ি আনা বন্ধ করে দেন তাহলে এ শিল্প ঘুরে দাঁড়াবে। মিরপুর বেনারসি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বেনারসির কারখানায় মাকুর চলনের সেই শব্দ আর নেই। নেই খটাখট আওয়াজ। জ্যাকার্ড নকশার ছিদ্র করা চিকন বোর্ড গুলোতে ঝুল জমেছে। তাঁতে নেমে আসা সুতার সারিতে বাসা বেঁধেছে উঁইপোকা। মাকড়সার জাল ছড়ানো।
জানা গেছে, মিরপুরের বিহারী ক্যাম্পগুলোতেই রয়েছে বেশির ভাগ বেনারসি কারখানা। সম্প্রতি সড়ক প্রশস্থ হওয়ায় রাস্তার উপর থাকা বেশ কয়েকটি ক্যাম্প ভাঙ্গা পড়েছে। এতে কয়েক’শ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বেনারসি পল্লীতে বর্তমানে দোকান রয়েছে ১১৫ টির মতো। বেশিরভাগ দোকান ভারতীয় বেনারসি শাড়িতে টইটুম্বর। দেশীয় বেনারসি বড় জোড় ২’ভাগ রয়েছে । আবার অনেক দোকানে দেশীয় বেনারসি শাড়ি নেই বললেই চলে। ২০০০ সালের হিসাব অনুযায়ী ৬ হাজরের বেশি তাঁত ছিল মিরপুরে। সেখান থেকে কমতে কমতে তলানিতে এসে ঠেকেছে অনেক আগেই। কারন আর কিছুই নয় স্রেফ অবহেলা। এখনো যে তাঁত আছে তার মধ্যে চলছে গুটিকয়। আবার করোনায় মার্চ মাস থেকে কারখানা বন্ধ থাকায় অনেক তাঁত নষ্ট হয়ে গেছে। এ দিকে করোনায় বেশিরভাগ দোকান ক্রেতা শূন্য। বেনারসি শাড়ি, জামদানি,লেহেঙ্গা কাতান শাড়ি সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান কেন্দ্রিক রেডিমেড পোশাক দোকানে সাজিয়ে রাখা হলেও তা যেন নামানোর প্রয়োজন পড়ছে না। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান বন্ধ থাকায় বেচা কেনায় আকাল পড়েছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। দু’একজন ক্রেতার দেখা মিললেও তাতে দোকান ভাড়া মিটিয়ে কর্মচারীর বেতন ভাতা দেওয়া সম্ভব নয়। অনেকে ৩-৪ দিন কিছুই বিক্রি করতে পারেন নি বলে আক্ষেপ করেন।
মিরপুর ১১ নম্বরের মুল সড়কটি চলাচলের অনুপযোগি হওয়াায় ওই এলাকার বেনারসি শাড়ির দোকানগুলোতে ক্রেতারা যেতে চান না। বেশ কয়েক বছর সড়কটি কেটে খুঁড়ে রাখা হয়েছে। বসানো হয়েছে সড়কে অনেক ধরনের দোকানপাট। তাই গাড়ী চলাচল করতে পারেনা। দিয়া শাড়ির সত্তাধিকারী ও মিরপুর বেনারসি দোকান মালিক সমিতির সাধারন সম্পাদক মোঃ কাশেম বলেন, নব্বই দশক ছিল বেনারসি শাড়ির স্বর্নযুগ। ওই সময় মিরপুর ১০ নম্বরে শাড়ির দোকানের পাশাপাশি বেনারসি কারখানাও ছিল। কারখানায় উৎপাদিত শাড়ি দেশের বিভিন্ন এলাকা এমনকি ভারতে পর্যন্ত যেত। নামে বেনারসি পল্লী হলেও এখানে সরকারি সুযোগ সুবিধা মেলেনি। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সুবিধা নেই। সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স পাওয়া যায় না। এ ছাড়া সরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের হয়রানি সহ নানান কারনে কারখানাগুলো বিহারী ক্যাম্পে চলে গেছে। তিনি বলেন, বেনারসি তাঁত শিল্প ঘুরে দাড়াতে হলে ভাসানটেকে প্রকৃত তাতীঁদের যতদ্রুত্ব সম্ভব পুর্নবাসন করতে হবে। সেই সাথে মাদারীপুর ও শরীয়তপুর প্রকল্পের দ্রুত্ব বাস্তবায়ন, বিদেশে রপ্তানির সুযোগ ,ভারতীয় শাড়ির অবাধ প্রবেশ রোধ, সহজ শর্তে ঋন , আধুনিক মেশিনে শাড়ি উৎপাদনের ব্যবস্থা, শাড়ি তৈরির কাঁচামালের উপর ভ্যাট প্রত্যাহার সহ প্রয়োজনীয় গবেষনা ও উন্নয়নের উদ্যোগ নিতে হবে। মাসুম নামে এক তাঁত শ্রমিক বলেন, একটি বেনারসি শাড়ি বানাতে খরচ হয় ৩-৪ হাজার টাকা। শোরুম মালিকরা সর্বোচ্চ দাম দেয় ৪ হাজার টাকা। যে টাকা খরচ হয় যদি সে টাকাই বিক্রি করতে হয় তাহলে চলবে কি করে। অন্যদিকে ২-৩ হাজার টাকায় ভারতীয় বেনারসি শাড়ি কিনে মিরপুরের বেনারসি শাড়ি বলে শোরুম মালিকরা ১০ হাজার টাকায় বিক্রি করছেন। তিনি বলেন, শোরুম মালিকরা আজ কমদামি ভারতীয় বেনারসি শাড়ি এনে আমাদের এ দশা করেছেন। সরকারি সুযোগ সুবিধা আমাদের মধ্য পর্যন্ত আসেনা তাতী না হলেও তাতীদের নেতা সেজে বসে আছে অনেকেই।
মিরপুর ১১ নম্বর এডিসি ক্যাম্পের কয়েকজন তাঁতী জানান তাঁত বোর্ডের উদ্যোগে বেনারসি প্রাথমিক তাঁতী সমিতি করা হয়েছে। কোথাও তাঁত বন্ধ হয়ে গেলে তা চালু করা সহ তাঁতীদের বিভিন্ন সমস্যা দেখার কথা এ সমিতির। অথচ তা তারা করছেন না। সমিতির সদস্য হতে অনেকে তাঁতী সেজেছেন। এ জন্য ২ -১ টি তাঁত বসিয়েছেন। যারা এ সমিতির নের্তৃত্ব দিচ্ছেন তারা অনেকে বেনারসি শাড়ির দোকান মালিক। তাঁতীদের দুঃখ কষ্ট তারা কি বুঝবে। নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য পরিবারের সদস্যদের দিয়ে তাঁতীর তালিকায় নাম উঠিয়েছেন। ভবিষ্যতে যাতে ভাসানটেকে তাতীঁদের পুর্নবাসনের জায়গায় প্লট নিতে পারেন। অনেক সময় তাঁত বোর্ডের সদস্যরা তাঁতীদের খোঁজ খবর নিতে মাঠ পর্যায়ে আসেন। সমিতির নেতারা নিজেদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে ওই কর্মকার্তদের আপ্যায়ন করিয়ে বিদায় দেন। তাঁতীদের আর খোঁজ নেয়া হয় না।
বেনারসি শাড়ির মুল উৎপত্তিস্থল হিসেবে ভারতের বেনারস শহরের নাম শোনা যায়। এই শাড়ি মানব চালিত একটি যন্ত্রেও সাহায্যে তৈরি করা হয়। আর কারীগরদের বলা হয় তাঁতী। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় ভারতের বেনারস থেকে প্রায় ১০০ টি মুসলিম তাঁতী পরিবার তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে চলে আসে। তারা ঢাকার মিরপুর ও পুরান ঢাকায় বসতি স্থাপন করে। তারা তাদের আদি পেশা তাঁত শিল্পের কাজ এ দেশে এসেও অব্যাহত রাখে। নান্দনিক ডিজাইন,উন্নত রুচি, এবং নিপুন বুননের কারনে বাংলাদেশসহ বিশের বিভিন্ন দেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৭১ সালের পর পুরান ঢাকা থেকে তাঁতীরা মিরপুর স্থান্তরিত হয়ে বেনারসি পল্লী গঠন করে।
মিরপুর ৩ নং ওয়ার্ড বেনারসি প্রাথমিক তাঁত সমিতির সভাপতি মোঃ রফিক বলেন, তাঁতীদের পুর্নবাসনের জন্য ভাষানটেকে ৯০৬ টি প্লট বরাদ্দ হলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। কয়েক যুগ পেরিয়ে গেছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে তাঁতীদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরন হবে। হয়তোবা বেনারসি তাঁত শিল্প আবারো ঘুরে দাঁড়াবে।