বাংলাদেশ একাত্তর.কম/ সুমন আহমেদ:
আরজু ওরপে গান্ধা আরজু। পল্লবীর ১১ নম্বর ফুটবল গ্রাউন্ড ক্যাম্পের বাসন্দিা। লিকলিকে গড়নে উচ্চতায়ও বেশ। বখাটে স্টাইলে চুলের কাটিং কানে রয়েছে দুল। বয়স ২৫ ছুঁইছুঁই। চলাফেরায় পুরোদস্তুর কেতা দুরস্থ। দলবেঁধে দাপিয়ে বেড়ান মহল্লার অলিগলি। বিরামহীন ছুটে চলা। ছিনিয়ে নেয়ার নেশায় মত্ত থাকেন সারাক্ষন। অনেকেই হন সর্বশান্ত আবার অনেকে রক্তাক্ত। বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে গাঁদাগাঁদা অভিযোগ থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে কেউ টুশব্দ করে না। করলেই প্রাননাশের শঙ্কা। অকথ্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এমন পরিবারের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়।
পল্লবী জুড়ে চলছে আরজু বাহিনীর তান্ডব। লাগাম টানার কেউ নেই। সূত্র জানায় মিরপুর ১১ ফুটবল গ্রাউন্ড ক্যাম্পের বাসিন্দা আরজু স্থানীয়ভাবে বিহারী আরজু হিসেবে পরিচিত। আলোচিত বিহারী নেতা মোস্তাকের ভাতিজা ও পুলিশের তালিকাভুকত মাদক ব্যবসায়ী মিস্টারের চাচাতো ভাই হওয়ার সুবাদে এলাকায় রয়েছে আলাদা দাপট। চাচা বিহারী নেতা মোস্তাক বিভিন্ন সময় মাদকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সভা সমাবেশ করেন। আর ভাতিজা আরজু পল্লবী জুড়েই বসিয়েছেন মাদকের হাট। আরজুর নিয়ন্ত্রাধীন এমসিসি ক্যাম্প, ফুটবল গ্রাউন্ড ক্যাম্প,শাহীন স্কুল ক্যাম্প,কাইল্লা বস্তি, নন লোকাল রিলিপ ক্যাম্পে , এভিনিউ ফাইভে রয়েছে বেশ কয়েকটি কিশোর গ্যাং।
মাদক ,চুরি, ছিনতাই, অন্যের হয়ে মারামারি , জবর দখল , বিএনপির মিছিল মিটিং ও হরতাল অবরোধে লোক সরবরাহ সহ সব কিছুতেই যেন অঘটন ঘটন পটিয়সী গ্যাং সদস্যরা। সদস্যদের বিশিরভাগই বখে যাওয়া তরুন।অনেকে স্কুল আঙ্গিনায়ও পা রাখেনি। গ্যাং প্রধান আরজুর আঙ্গুলির হেলনিতে মুহুর্তেই চলে তান্ডব। সরজমিন মিরপুর ১১ নম্বর ফুটবল গ্রাউন্ড ক্যাম্প এলাকায় গিয়ে জানা যায় বেশ কয়েক বছর আগে ১১ নম্বর-সি ব্লক, ১০ নম্বর রোডের ৬ নম্বর লাইনের একটি বাড়িকে( স্থানীয়ভাবে ভুতের বাড়ি , ভাঙ্গা বাড়ি হিসেবে পরিচিত) মাদকের আস্তানা বানিয়ে পল্লবী এলাকায় মাদক বেচা শুরু করেন গান্ধা আরজু ওরপে বিহারী আরজু। বাড়ির মালিক ও কেয়ার টেকার প্রতিবাদ করলে তাদের অকথ্য ভাবে নির্যাতন করা হতো। মাস খানেক আগে বাড়িটি বিক্রি করা হয়। বাড়ির আগের মালিক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, আরজুর ব্যাপারে আমি কিছু বলতে রাজি না। এখন আর বলে কি হবে। জানের নিরাপত্তা দিবে কে?
এ দিকে ১৬ ডিসেম্বরের মিষ্টি খাওয়ার খরচ না দেওয়ায় এক ব্যবসায়ী সহ ৩ জনকে কুপিয়েছে আরজু ও তার সহযোগিরা। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে দশটায় পল্লবীর ১১ নম্বরের এভিনিউ ফাইভের হাজী হোটেলের সামনে ঘটনাটি ঘটে। এ ঘটনায় আরজু সহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে ১৯ ডিসেম্বর শনিবার পল্লবী থানায় মামলা হয়েছে। মামলার অন্য আসামিরা হলেন, মোঃ ওয়াহিদ,মোঃ সোহাগ ,মোঃ এহতেশাম,মোঃ আশিক, মোঃ আমান,মোঃ রাসেল, মোঃ সাকিল, মোঃ আকাশ,মোঃ সৈকত,মোঃ ইমন,মোঃ রানা সহ অঞ্জাত ৭-৮ জন।
মামলার সূত্রে জানা গেছে আরজু তার বাহিনী নিয়ে মিরপুর ১০ নম্বরে সামিয়া সিল্ক হাউজ নামে একটি বেনারসী কাপড়ের দোকান গিয়ে ১৬ ডিসেম্বরে মিষ্টি খাওয়ার খরচ চান। মিষ্টির খরচ না দেওয়ায় ফিল্মি স্টাইলে ওই ব্যবসায়ীর উপর ধারালো অস্ত্র ও চাপাতি দিয়ে হামলা চালানো হয়। আরজু ও তার বাহিনীর শতাধিক গ্যাং সদস্য এ হামলায় অংশ নেয়। এর মধ্যে ১৩ জনকে চিহ্নিত করা গেছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পল্লবী থানার এস আই জহির উদ্দিন বলেন, মামলা হওয়ার পরের দিনই আরজু জামিনে এসেছেন।
স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা জানান মাস ছয়েক আগে ১১/সি লেন ১৪ , রোড ১০ পল্লবীতে স্বামীর সামনে স্ত্রীকে উত্যক্ত করে আরজু। এ ঘটনায় ওই নারীর স্বামী আরজুকে বকাবকি করেন। এর কিছুক্ষন পর আরজু তার বাহিনী নিয়ে ওই বাড়িতে হামলা চালান। বাসা থেকে ডেকে নিয়ে ওই ব্যক্তিকে কুপিয়ে জখম করেন। মামলা করার সিদ্ধান্ত নিলেও বিহারী নেতা মোস্তাক ও তার ছেলে রাজুর হস্তক্ষেপে মামলা থেকে সরে আসেন ওই ব্যক্তি। ফুটবল গ্রাউন্ড ক্যাম্প সংলগ্ন ১০ নম্বর ও ১১ নম্বর রোডের কয়েকজন বাড়ির মালিক জানান, প্রতিমাসে আরজুর লোকজনকে নির্দিষ্ট পরিমান টাকা দিতে হয়। কেউ প্রতিবাদ করলে আরজু ও তার গ্যাং সদস্যরা বাসাবাড়িতে তান্ডব চালায়। সম্প্রতি এমন দু’টি ঘটনা ঘটেছে। ভয়ে কেউ থানায় অভিযোগ দেয়নি। কলেজ পড়ুয়া কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, কারো হাতে দামি মোবাইল ফোন সহ মুল্যবান জিনিস পত্র দেখলে বিভিন্ন ফাঁদে ফেলে তা হাতিয়ে নেয় আরজু বাহিনী। সিকদার নামে কলেজ পড়ুয়া এক শিক্ষার্থী জানান, বাসায় বন্ধুদের নিয়ে গল্প করার সময় একদিন দলবল নিয়ে হাজির হন আরজু। উপস্থিত সবাইকে জেরা করেন। আমাদের কাছে ইয়াবা ও চোরাই মোবাইল আছে বলে ফিটিং চান। স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে মোবাইলে বিষয়টি জানালে তিনি সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হোন। আরজু তার আগেই সটকে পড়েন। ওই সময় আরজুর চাচা বিহারী নেতা মোস্তাকও ঘটনাস্থলে হাজির হন। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে কাউন্সিলর তাকে বলে যান। আরজুর ব্যাপারে জানতে চাইলে বিহারী নেতা মোস্তাক বলেন, আরজু আমার ভাতিজা হলেও আমার করার কিছু নেই। সে কারো কথা শুনে না।
ঠুনকো কথাকাটির জেরে গত বছর জুন মাসের ২ তারিখ বিহারী নেতা ফাক্কু ও শাহিদ আলী বাবুল ও তার পরিবারের উপর অতর্কিত হামালা চালায় আরজু বাহিনী। এ হামলায় ৫ জনকে কুপিয়ে জখম করা হয়। এ ঘটনায় আরজু সহ কয়েক জনকে আসামি করে পল্লবী থানায় ২ টি মামলা হয়েছে।
স্থানীয় কয়েকজন ভুক্তভোগী জানান, সন্ধ্যার পর প্যারিস রোডের কাইল্ল্যা বস্তির সামনে চুরি ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ঘটে। আরজু বাহিনী এ সব অপকর্মের সাথেই জড়িত থাকে। তারা প্রতিনিয়ত সেখানে আড্ডা দেন। পল্লবী থানা আওয়ামী লীগের এক সদস্য জানান, স্থানীয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাদের প্রশ্রয়ে আরজু ও তার গ্যাং সদস্যরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। আরজুর উপর ভর করে তারা বিভিন্ন অপকর্ম করছেন। এখনই আরজুর লাগাম টেনে না ধরলে এক সময় শীর্ষ সন্ত্রাসীর খাতায় নাম লেখাবে।
এ দিকে কিশোর গ্যাং প্রধান আরজুর বিরুদ্ধে পল্লবী থানায় ৩ টি হত্যাচেষ্টা সহ চাঁদাবাজির মামলার সন্ধান মিলেছে। বিএনপির হরতাল অবরোধের সময় গ্যাং সদস্যদের দিয়ে গাড়ি ভাংচুর ও টায়ার পোড়ানো সহ পিকেটিং এর অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য ও ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কাছে রয়েছে একাধিক অভিযোগ।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ডি এন সি সি’র ৩ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর কাজী জহিরুল ইসলাম মানিক বলেন, আমার ওয়ার্ডে ৭ জন কিশোর কে কাউন্সেলিং করে সংশোধন করা হয়েছে। সবাই পড়াশুনায় মনোযোগ দিয়েছেন। আরজুর ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আরজুর অভিভাবকের সাথে কথা হয়েছে। সে কাজ করছে। যদি কাজ ছেড়ে আবার আড্ডা দেয় ব্যবস্থা নিব।
পল্লবী থানার ওসি কাজী ওয়াজেদ আলী বলেন, কিশোর গ্যাং অপরাধীদের তালিকা হচ্ছে। আরজুর ব্যাপারে তথ্য দেন। ব্যবস্থা নেব।
মিরপুর বিভাগের ডিসি আ স ম মাহতাব উদ্দিন বলেন, কিশোররা অপরাধের সাথে যুক্ত হচ্ছে কিনা , সে বিষয়গুলো আমরা ক্ষতিয়ে দেখছি। অপরাধে যুক্ত হলেই তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।