পল্লবীতে প্রতারণার দায়ে কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিঃ এ র্যাবের হানা- গ্রেফতার ১০, মুল হোতা জসিম পলাতক
বাংলাদেশ একাত্তর.কম/ নিজেস্ব প্রতিবেদকঃ
রাজধানীর পল্লবী হতে প্রতারণার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া “কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিঃ” এর প্রকল্প পরিচালক শাকিল আহম্মেদসহ ১০ জনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব-৪। মুল হোতা জসিম পলাতক রয়েছে।
সাম্প্রতিককালে রাজধানীসহ সারা দেশে প্রতারণার নতুন নতুন কৌশল ব্যবহার করে নারী পুরুষ সহ সাধারণ মানুষকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে তাদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এক শ্রেণীর পেশাদার প্রতারক চক্র।
অতি সম্প্রতি মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম), ই-কমার্স, সমবায় সমিতি, এনজিও, অনলাইন ব্যবসার মাধ্যমে অসংখ্য মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে সর্বশান্ত করার বেশকিছু অভিযোগ পেয়েছে র্যাব।
এই সকল প্রতারকদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে বেশকিছু সফল অভিযান পরিচালনা করেছে র্যাব। মিরপুর এলাকার কতিপয় ক্ষতিগ্রস্থ ভুক্তভোগীদের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের প্রেক্ষিতে অদ্য ২৫ অক্টোবর ২০২১ তারিখ দুপুর ১টা.৩০ ঘটিকা হতে ২৬ অক্টোবর ৮টা ৩০ ঘটিকা পর্যন্ত র্যাব-৪ এর একটি চৌকস আভিযানিক দল মহানগরীর পল্লবী থানাধীন ১১/এ, রোড নং-৬, প্লট-৪, নান্নু সুপার মাকের্টে অভিযান পরিচালনা করে প্রতারণা দায়ে “কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিঃ” এর চেয়ারম্যানের অন্যতম সহযোগী এবং প্রকল্প পরিচালক মোঃ শাকিল আহম্মেদ (৩৩) সহ মোট ১০ জনকে গ্রেফতার করতে সমর্থ হয়। অভিযানকালে সভাপতি জসিমসহ সমিতির কার্যকরী কমিটি অন্যান্য সদস্যদের পাওয়া যায় নি।
অভিযান কালে “কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিঃ” অফিস হতে প্রতারণায় ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রী যেমনঃ ১৭ টি মুদারাবা সঞ্চয়ী হিসাব বহি, ২৬ টি চেক বহি, ২ ডিপোজিট বহি, ৩ টি সীল, ১২০ টি ডিপিএস বহি, ১ টি রেজিস্টার বহি, ১ টি নোটবুক, ১ টি স্যালারী শিট, ৩০ টি জীবন-বৃত্তান্ত, ৫ টি ক্যালেন্ডার, ৮ পাতা ডিপিএস এর মাসিক হিসাব বিবরণী, ৩ টি পাসপোর্ট, ১ টি ডিভিআর মেশিন, ভুক্তভোগীদের অভিযোগ কপি ২৮ পাতা, ১ টি ব্যানার এবং নগদ ৪,২২,০৮০/-টাকা জব্দ করা হয়।
গ্রেফতারকৃতরা হলো ১। মোঃ শাকিল আহম্মেদ (৩৩), জেলা-নরসিংদি। ২। মোঃ চাঁন মিয়া (৩৮), জেলা-মাগুড়া।
৩। এ কে আজাদ (৩৫), জেলা-বাগেরহাট। ৪। মোঃ রেজাউল (২২), জেলা-বড়গুনা। ৫। মোঃ তাজুল ইসলাম (৩১), জেলা-গাইবান্ধা। ৬। মোঃ শাহাবুদ্দিন খাঁন (২৮), জেলা-কুমিল্লা। ৭। আব্দুস ছাত্তার (৩৭), জেলা-ময়মনসিংহ। ৮। মোঃ মাসুম বিল্লা (২৯), জেলা-চাঁদপুর। ৯। মোঃ টিটু মিয়া (২৮), জেলা-মাগুড়া। ১০। মোঃ আতিকুর রহমান (২৮), জেলা-মুন্সিগঞ্জ।
প্রতারক সংগঠনের কার্যপদ্ধতি টার্গেট/ভিকটিম/সদস্য সংগ্রহঃ
এই প্রতারক চক্রের মাঠ পর্যায়ের কর্মী/সদস্য রয়েছে। এরা রাজধানীর মিরপুরস্থ বিভিন্ন বস্তি এলাকার গার্মেন্টসকর্মী, রিক্সাচালক, ভ্যানচালক, অটোচালক, সবজি ব্যবসায়ী, ফল ব্যবসায়ী, গৃহকর্মী ও নিম্ম আয়ের মানুষদের টার্গেট করে স্বল্প সময়ে মাসিক মেয়াদ শেষে অধিক মুনাফা লাভের প্রলোভন দেখিয়ে তাদের কোম্পানী’তে বিনিয়োগ/ডিপিএস করতে উদ্ভুদ্ধ করত। ভিকটিমদের প্রলুব্ধ করে এবং তথ্যাদি সংগ্রহ করে ভুলিয়ে নানান কৌশলে প্রতারক চক্রের অফিস কার্যালয়ে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হতো। এদেরকে প্রতি গ্রাহক/টার্গেট সংগ্রহের জন্য নির্দিষ্ট অংকের টাকা (চবৎপবহঃধমব) দেওয়া হতো। উক্ত প্রতিষ্ঠানে কেউ যদি একটি ডিপিএস মাসে ১,০০০/- টাকা করে বছরে ১২,০০০/-টাকা জমা দেয় তবে পাঁচ বছরের ৬০,০০০/- টাকা জমা হবে, মেয়াদ শেষে তাকে ৯০,০০০/-টাকা প্রদান করা হবে এবং টার্গেট সংগ্রহকারী ব্যক্তি প্রথম ১ বছর প্রতিমাসে ২০০/-টাকা এবং পরবর্তী ৪ বছর প্রতিমাসে ১০০/-টাকা করে লভ্যাংশ পাবে। আবার কোম্পানীর কোন সদস্য যদি নতুন কোন সদস্য’কে ১,০০,০০০/-টাকার এফডিআর করাতে পারে তাহলে টার্গেট সংগ্রকারীকে মাসে ১,০০০/-টাকা এবং এফডিআর কারী সদস্য’তে মাসে ২,০০০/-টাকা প্রদানের প্রলোভন দিত প্রকৃতপক্ষে যা বাংলাদেশে কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠান দিতে পারেনা।
মূল অভিযুক্ত পলাতক আসামী জসিম উদ্দিন নিজ জেলা মুন্সিগঞ্জ। সে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স পাশ করেছে। তার ২ জন স্ত্রী এবং ২ পুত্র সন্তান রয়েছে। পূর্বে একটি ইন্সুরেন্স কোম্পানীতে রিপ্রেজেন্টিটিভ হিসেবে কর্মরত ছিল। পরবর্তীতে ২০০৩ সালে সে অল্প সময়ে অধিক মুনাফা লাভের আশায় “কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিঃ” প্রতিষ্ঠা করে কিন্তু সমবায় অধিদপ্তরের নিবন্ধন লাভ করে ২০০৬ সালে। এবং ২০১৩ সালে সমিতিটির পূনর্নিবন্ধন হয়। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ২০১৮/২০১৯ সালের তাদের মোট সদস্য সংখ্যা ৫৩৭ জন কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নিয়ম বহির্ভূতভাবে ২৫-৩০ হাজার সদস্য গ্রাহক সংগ্রহ করেছে। সে কোম্পানীতে নতুন নতুন সদস্য আনয়নের লক্ষ্যে পুরাতন সদস্যদের চাপ প্রদান করতো এবং তাদের মুনাফার লোভ দেখাতো। তার এই “কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিঃ” এর আনুমানিক ২৫-৩০ হাজার গ্রাহক রয়েছে যারা ডিপিএস ও এফডিআর এর মাধ্যমে বিনিয়োগ করেছে এবং যার পরিমান আনুমানিক শতকোটির উপরে বলে অনুসন্ধানে জানা যায়। টাকা চাইতে গেলে গ্রাহকদের হুমকি ধামকি, মারধর করা ও মামলার ভয় দেখানো হতো। জসিমের নির্দেশে গ্রেফতারকৃত শাকিল ও চাঁন মিয়া ভুক্তভোগীদের মারধরসহ শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন করতো। জসিমের নামে ৮ টি নামসর্বস্ব কোম্পানীর সন্ধান পাওয়া যায়।
১। কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিঃ। ২। জসিম মডার্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার। ৩। কর্নফুলি রিয়েল এস্টেট লিঃ। ৪। জসিম ইন্টাঃ ওভারসিস লিঃ। ৫। জসিম স্টুডেন্ট কনসাল্টেন্সি ফার্ম লিঃ। ৬। জসিম ট্যুরস্ এন্ড ট্রাভেলস। ৭। জসিম ওয়েলফার ফাউন্ডেশন।
৮। জসিম নীট কম্পোজিট লিমিটেড।
“কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিঃ” এ কোম্পানী ছাড়া বাকি ০৭ টি কোম্পানীর কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তার সকল আয়ের উৎস হচ্ছে “কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিঃ” এ ভুক্তভোগীদের ডিপিএস/এফডিআর এর টাকা। জসিম অত্যান্ত ধূর্ত প্রকৃতির, অধিকাংশ সময়েই সমিতির অফিসে আসত না, সমিতির ব্যাংক হিসাবে টাকা জমা হওয়ার সাথে সাথে তা উত্তোলন করে অন্যত্র স্থানান্তর বা জমি/ফ্ল্যাট কিনে টাকা লেয়ারিং করত। উক্ত সমিতির সভাপতি জসিম নিজে, সহ-সভাপতি তার শ্বশুর মোতালেব সরকার, সাধারণ সম্পাদক তার প্রথম স্ত্রী লাকী আক্তার এবং কোষাধক্ষ তার শ্যালিকা শাহেলা নাজনীন, এমনকি যুগ্ন-সম্পাদক তার নিকট আত্মীয় লাভলী আক্তার। প্রতারণার মাধ্যামে অর্জিত টাকায় জসিমের নামে জমি, ফ্ল্যাট, গাড়ী, বাড়ি, ডায়াগনোষ্টিক সেন্টারসহ বিপুল পরিমান অবৈধ অর্থের সন্ধান পাওয়া গেছে।
ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাকিল আহম্মেদ (৩৩) নিজ জেলা নরসিংদি। সে টঙ্গী কলেজ থেকে অনার্স পাশ করেছে। তার ১ স্ত্রী এবং ১ কন্যা সন্তান রয়েছে। সে ২০১৫ সালে “কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিঃ” এর প্রকল্প পরিচালক হিসেবে যোগদান করে। শাকিল যোগদান করার পর হতে গ্রাহকের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। সে অত্যান্ত সুচারুভাবে গ্রাহকদেরকে লোভনীয় অফার দিয়ে সমিতিতে ডিপিএস/এফডিআর এ টাকা রাখতে প্রলুব্ধ করত।
জানা গেছে উক্ত সমিতি সমবায় অধিদপ্তর কর্তৃক রেজিষ্ট্রিকৃত রয়েছে এবং শুধুমাত্র সমিতি সদস্যদের কাজ থেকে সমিতি পরিচালনার জন্য অনুমোদন রয়েছে। কিন্তু উক্ত কোম্পানীর আর্থিক লেনদেন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমোদিত নয় এবং এনজিও হিসাবে এবং মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরীর আর্থিক লেনদেনের জন্য অনুমোদিত নয়।
সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে র্যাব-৪ উক্ত অভিযানটি পরিচালনা করে। গ্রেফতারকৃত আসামীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়াধীন। অদূর ভবিষ্যতে এইরুপ অসাধু সংঘবব্ধ প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধে র্যাব-৪ এর জোড়ালো সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত থাকবে।