বাংলাদেশ একাত্তর.কম (গল্প ‘অজানা পথ’) লেখক : সুলেখা আক্তার শান্তা।
ছেলে ছেলে করে সব সময় মন ভারী করে রাখে জাহেদা। জাহেদার তিন মেয়ে- নাহিদা, হালিমা, মানহা। তারপরও তাতে তার সন্তানের আফসোস মেটেনা। তার দরকার পুত্র-সন্তান। না হয় এই সম্পত্তি দেখবে কে? মেয়েদের বিয়ে দিলে তারা চলে যাবে স্বামীর বাড়ি। ভিটায় বাতি জ্বালাতে ছেলের দরকার।
আলফাত আহমেদ স্ত্রী জাহেদাকে বলে। শোনো জাহেদা। আল্লাহ পাক আমাদের তিন মেয়ে দিয়েছে। তা নিয়েই আমাদের সন্তুষ্ট থাকা উচিত। এরাই আমাদের ছেলে এরাই আমাদের মেয়ে। জাহেদা স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বলে, তোমার এই কথায় আমার মন ভরবে না। ছেলে না থাকলে অন্ধকার ঘর আলো করবে কে? তার চেয়ে আমরা কারো কাছ থেকে ছেলে দত্তক নেই।
ছেলে তো আনবা, পরে চলে গেলে তার আঘাত সইতে পারবা?
পরের ভাবনা পরে। চলো আজ আমরা বোন দিলারার বাড়ি বেড়িয়ে আসি। চলো যাই। মেয়েদের কি করবা?
ওদের এখন স্কুলের সময় হয়েছে ওরা স্কুলে যাবে। স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে রওনা দিলো দিলারার বাড়ির উদ্দেশ্যে। মাঝপথে দেখতে পেল। গাছের নিচে একটি মহিলা বাচ্চা নিয়ে বসে আছে, বাচ্চাটি মহিলাকে ধরে কাঁদে। বাচ্চাটি বয়স চার থেকে পাঁচ বছর হবে। জাহেদা রহিমাকে জিজ্ঞেস করে, বাচ্চাটা এভাবে কাঁদে কেন?
রহিমা বলে, কাঁদে কেন আমি কি করে জানব? বাবা-মা ছাড়া পোলাপান এমনই হয়। তারি মাঝে বাচ্চাটা জাহেদার কাপড়ের আঁচল ধরে তাকিয়ে আছে।
জাহেদা হাসি দিয়ে বলে, কি তুমি আমাকে চেনো? বাচ্চাটি মিটি মিটি হাসি দেয়। রহিমা বলে, আর বলেন না এই বাচ্চা নিয়ে আমার হয়েছে যত জ্বালা। কোথাও যাইতে পারি না, এরে রাইখা। বাবা-মা মইরা তো বাঁইচা গেছে। আমার হয়েছে মরন। কোথাও দিতে পারলে বাসতাম। জাহেদা তাৎক্ষণিক কথাটা ধরে, বলে, তুমি বাচ্চাটা কাউকে দিতে চাও? দিতে তো চাই। কেউ তো নিতে চায় না। তাহলে আমাকে দিবে? আপনি নিবেন? তাহলে আমার জন্য ভালই হয়।
জাহেদা স্বামীকে ইশারা করে, কি করা যায়?
আলফাত উত্তরে বলল, দেখো তুমি যা ভালো মনে করো।
জাহেদা জানতে চায় রহিমার কাছে? তোমাকে বাচ্চার জন্য কিছু দিতে হবে? রহিমা কিছু দিতে পারলে দেন। জাহেদা স্বামীর কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে দেয় রহিমাকে। রহিমা সেই টাকা খুলে দেখে না, যা দিয়েছে তাই নিয়ে সে খুশি। জাহেদা নিজে থেকেই বাড়ির ঠিকানা দিল রহিমাকে। তোমার যখন আসতে মন চায়? তুমি এসে দেখে যেও। রহিমা আচ্ছা।
জাহেদা এরপর বোন দিলার বাড়ি যেতে আগ্রহ করল না। সে স্বামীকে বলে, চলো আমরা বাচ্চা নিয়ে বাড়ি ফিরে যাই। জাহেদা ছেলে পেয়ে, অনেক খুশি মনে বাড়ি ফিরে এলো। নাহিদা, হালিমা, মানহা তিনজনেই জিজ্ঞেস করে, মা সাথে এ কে? জাহেদা মেয়েদের বলে, তোদের জন্য ভাই নিয়ে এসেছি। হালিমা মা একে আবার কোথায় পেলে?
পায়েছি, তোরা ভাই ভাই করিস, তাই তোদের জন্য নিয়ে এলাম। এবার ভাইয়ের জন্য সুন্দর একটা নাম বল।
নাহিদা, হালিমা, মানহা তিনজনেই মিলে ভাইয়ের জন্য নাম রাখে বোরহান। বোরহানরে নিয়ে তাদের ভালোই যাচ্ছে দিন। ঘরে আনন্দ আর আনন্দ। বোরহান বোনরা পড়তে বসলে, পাশে যে বই খাতা ধরে। হালিমা চিৎকার করে মাকে ডাকে, মা বোরহানরে এখান থেকে নেও। ও আমাদের বই খাতা ধরে। মা ডাকলে ও বোরহান যায়না। বোনদের কাছে থাকতে তার ভালো লাগে। নাহিদা বলে, মা তুমি কেন বোরহানের আমাদের কাছে পাঠাও। বাবা আলফাত বলে তুমি কেন তোমার বোনদের বিরক্ত করো? তুমি আমার কাছে আসো, তোমাকে আমি গল্প শোনাবো। বাবা আমি পড়তে চাই? ঠিক আছে, তোমাকে স্কুলে ভর্তি করে দিবো।
দিলারা বোন জাহেদার বাড়ি বেড়াতে আসে। জাহেদা বোরহানের স্কুলে ভর্তি করার ব্যাপারে বোন দিলারা সাথে কথা বলে। দিলারা এই কথা শুনে বোনকে বলে, এই কাজ ভুলেও করোনা। ছেলে তো আর তোমার পেটে ধরণী। পরের ছেলে, কোথায় থেকে পেয়েছো তা একবার হিসাব করে দেখেছো? তিন মেয়ের পড়ালেখা নিয়ে চিন্তা করো। আর এরে দিয়ে তোমার জমি ক্ষেতে কাজে লাগিয়ে দাও। জাহেদা ভাবে ঠিক কথাই বলেছে দিলারা। ছেলের পড়ালেখা করার দরকার নেই। পরে আবার মেয়েদের সাথে সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলা করবে। তা চেয়ে ক্ষেতের কাজ করানোই ভালো। তাতে সম্পত্তি রক্ষা হবে।
জাহেদা স্বামীকে বলে, কাল থেকে তোমার সাথে বোরহানরে ক্ষেতে কাজে নিয়ে যাবে। আলফাত চমকে ওঠে! এইটুকু ছেলেরে? তুমি এসব কি বলো? ও যাবে স্কুলে। জাহেদা মুখ ঝামটা মেরে, আমি যা বলি তুমি তাই করো। ঠিক আছে, আগামীকাল থেকে নিয়ে যাবা।
সকালে ঘুম থেকে উঠে আলফাত বোরহানরে ডাকে, বাবা চলো আমার সাথে ক্ষেতের কাজে যাবে।
বোরহান বলে, বাবা আমি স্কুলে যাব। আলফাত বলে, বাবা তুমি আমার সাথে যাবে। স্কুলে যেতে হবে না। বোরহান পরে বাবার সঙ্গে ক্ষেতের কাছে লেগে পড়ল।
রহিমা সেই যে আলফাত আর জাহেদার হাতে তুলে দিয়েছে বোরহানরে। আর একবারও খোঁজ নিতে আসেনি। বোরহান প্রকৃতপক্ষে জানে না কোথায় তার বাড়ি কে তার বাবা-মা কিছুই সে জানে না। যাদের কাছে আছে জানে এরা তার বাবা-মা না। তার সত্ত্বেও তাদের বাবা-মায়ের মতোই ভালোবাসে। আলফাত এক এক করে তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছে। জমি ক্ষেতের সমস্ত ভার আলফাত এখন ছেলে বোরহানের উপরে ছেড়ে দিয়েছে। আলফাত শুধু সংসার পরিচালনা করে আর টাকা-পয়সার দায়িত্বভার নিজের কাছে রেখেছে। লোকজন আলফাতকে বলে, ছেলেটা সেই যে তোমার সংসারে এসে খাটনি শুরু করেছে। আর এই ছেলের কারণে তোমার সম্পত্তি নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। সবই তো বোরহান সামাল দেয়। তবে এখন ছেলেটাকে ভালো একটা মেয়ে দেখে বিয়ে করিয়ে দাও? হ্যাঁ ভালো কথাই বলেছো। তবে তোমাদের জানাশোনা ভালো মেয়ে থাকলে আমার বোরহানের জন্য দেখো। ঠিক আছে, বলেছো যখন, তখন দেখবো।
আলফাত বাড়ি এসে স্ত্রীকে বলে, জাহেদা লোকজন বলাবলি করে। আমরা ছেলের কথা ভাবি না। ছেলেরে বিয়ে করার উপযুক্ত সময়। তাও আমরা বোরহানরে বিয়ে করাচ্ছি না। জাহেদা বলে, লোকজন যখন এই কথা বলাবলি করছে? তখন তো বিয়ে করাতেই হবে? শোনো নাহিদার বাপ? আমি তোমাকে বলি, ভালো ঘরের মেয়ে দেখে দরকার নেই। বোরহানের জন্য গরিব ঘরের মেয়ে বিয়ে করিয়ে আনলেই হবে। আমাদের কথা শুনবে। বড় ঘরের মেয়ে হলে দাপট দেখাবে। বোরহানের জন্য আলফাতের মায়া থাকলেও কিন্তু দেখাতে পারেনা স্ত্রীর যুক্তির কারণে।
বোরহানের বিয়ে হয় সুন্দরী এক মেয়ের সঙ্গে। ধনী নয় তাতে কি? সুন্দরী বউ পেয়েছে তাতেই সুখী বোরহান। বারনি স্বামী বোরহানের এই সংসারে অবস্থান দেখে বুঝতে পারে। সে স্বামী পেয়েছে, এখান কার টাকা-পয়সা জমি-ক্ষেত কিছুই পাবেনা। এই বাড়ির বিষয় সম্পত্তির উপর তার কোন অধিকার নেই। শুধু পেটে-ভাতে। মুখেই যা আদর। বারনি স্বামীকে বলে, সব সম্পত্তি তিন মেয়ের নামে লিখে দিয়েছে। ছেলে হিসাবে তোমার কথা তো ভাবলো না। বোরহান স্ত্রীকে বলে, এ নিয়ে তুমি ভেবোনা। আল্লাহ আমাকে সম্পূর্ণভাবে সুস্থ রেখেছে। আমি তোমাকে নিয়ে মরবো না। এই দুনিয়ায় কোথাও না কোথাও আমাদের ঠাঁই হবেই। বারনি বলে, তোমার মত স্বামী পেয়েছি তাতেই আমি সন্তুষ্ট। আমি তোমার সাথে গাছ তলাতেও থাকতে পারবো। শুধু তুমি আমার থাকলেই হবে। বলো তুমি আমার থাকবে না?
বোরহান মুচকি হাসি দিয়ে বলে, আমার বউ বলে কি! আমি তোমার না কার থাকবো? অন্য কারো হবো বুঝি? এই কথা তুমি বললে, যাও আমি তোমার সাথে কথা বলবো না। বারনি আরে রাগ করো কেন? বুঝতে পারলাম আমি যেমন তোমার তুমিও তেমন আমার। আমি তো তোমার সাথে দুষ্টামি করলাম। আমি কি তোমার সাথে দুষ্টুমি করতে পারিনা? বোরহান জড়িয়ে ধরে বারনিরে, হ্যাঁ, হ্যাঁ তুমি পারো দুষ্টুমি করতে। দু’জন দু’জনকে পেয়ে তাদের মাঝে সুখের অভাব নেই।
এখন আছে শুধু বাড়ি। এই ব্যাপারে আলফাত একটু চিন্তিত। আলফাতের মনে হল আজ যদি আমার নিজের ছেলে হতো বোরহান। আমি কি পারতাম আমার ছেলেরে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে। বাড়ি আমি বোরহানের নামে লিখে দেবো। আলফাত কাগজপত্র ঠিক করে, বোরহানের নামে বাড়ি লিখে দিবে।
এমন সময় জাহেদা বলে, তা হবে না। তিন মেয়ে তা মানবেই না। তার সাথে জামাইরা ও ক্যাচাল করবে। তুমি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছো তা বন্ধ করো। আলফাত কি আর করা স্ত্রীর কথা শুনে থেমে যায় তার সিদ্ধান্ত থেকে। জাহেদা স্বামীকে বলে, বেঁচে থাকতেই মেয়েদের নামে বাড়ি লিখে দাও। না হয় তোমার ভাইয়ের ছেলে মেয়ে ঝামেলা করতে পারে। আলতাফ তাই করলো স্ত্রির কথা মতো লিখে দিল নিজের বাহাদুরী শেষ সম্বল।
বারনি স্বামীকে বলে, এখানে কি আশায় থাকবা? তারা তোমাকে কিছুই দিলো না। তোমার কিছু দরকার না থাকতে পারে আমাদের সন্তান হলে তার তো দরকার হবে? বোরহান বলে, আল্লাহ আমাকে কাজ করে খাওয়ার জন্য হাত-পা দিয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা তারা আমাকে লালন-পালন করেছে। বাবা-মায়ের আদর দিয়েছে। তুমি যদি সন্তুষ্ট থাকো আমার কোন আপত্তি নেই। তাও তোমাকে বলি, লালন-পালন করেছে তোমাকে ঠিকই, তার বদলে তোমাকে পড়ালেখা না করিয়ে জমি-ক্ষেতের কাজে দিয়েছে। কাজ করেছো তার বিনিময়ে ভাত খেয়েছ। বোরহান বেদনার মাঝেও হাসি দিয়ে বলে, শান্ত হও তুমি। বারনি বলে, আমার কথা তোমার শুনতে হবে? বলো তুমি কি বলতে চাও? আমরা এখান থেকে চলে যাব। কোথাও গিয়ে বাসা ভাড়া করে থাকবো।
বোরহান বলে, মানুষ শুনলে বলবে কি? ছেলে বাবা-মাকে ফেলে চলে গেছে! যখন তোমার প্রতি ছেলের দায়িত্ব পালন করেনি, তখন মানুষ দেখতে পায়নি? তারা তো তোমার সমাধান দিতে পারেনি? বোরহান বলে, বাবা-মাকে রেখে যেতে মন চায় না। কি করা। যেতে তো হবেই। এই ‘অজানা পথ’ আমাকে তো পাড়ি দিতে হবে। বাব-মার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। তারপর বাসা ভাড়া করে দু’জনে নতুন সংসার শুরু করে। বোরহান সামনের মাথায় যে কাজ পায় তাই করে, তা দিয়ে দু’জনের সংসার চলে। এরপর ঘর জুড়ে এলো টুকটুকে একটি পুত্রসন্তান। নাম রাখল সফল। বোরহান হঠাৎ জানতে পারে তার বাবা মারা গেছে! তাড়াতাড়ি বউ ছেলেকে নিয়ে চলে আসে বাবার বাড়ি। বাবার মরন খাট আমাকে ধরতে হবে। আমি যে তার ছেলে। বাড়িতে এলে মা জাহেদা ছেলে বোরহানকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। আর বলে, বাবা তুই আমাদের মাফ করে দে। তোরে আমরা তোর অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছি। সন্তানের দায়িত্ব পালন করিনি। বোরহান বলে, মা এতে বিন্দুমাত্র দুঃখ নেই আমার। তোমাদের কাছ থেকে বাবা-মা আদর ভালোবাসা পেয়েছি। এইতো আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া মা। বোরহান বাবার জন্য কাঁদে। এরপর বোরহান বাবার মৃৃৃত্যু দেহ কে দাফনসহ সম্পুর্ন কাজ করে। মা এই যে তোমার নাতি। কই দেখি দেখি। ওরে আমার দাদুভাই দাদির কোলে আসো। জাহেদা স্বামী হারানোর হাহাকার জুড়ালো নাতি কোলে নিয়ে। নাতিকে আদর করে বলে, দাদির দিকে তাকায় আছে আমার দাদুভাই। বোরহান মায়ের কোলে সন্তান দিতে পেরে শান্তি পেল। চোখ দুটি বন্ধ করে প্রশান্তি উপভোগ করল।